আল ফারাবী

রাষ্ট্রদর্শনে আল ফারাবীর অবদান


Image result for আল ফারাবীর

আল ফারাবী একজন খ্যাতনামা দার্শনিক। তাঁর পুরো নাম আবু নসর মুহাম্মদ বিন তুরখান বিল আওযালগ আল ফারাবী। আব্বাসীয় শাসনামলে ৮৭০ সালে তুর্কিস্থানের ফারাব শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ৯৫০ সালে দামেস্কে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আল ফারাবীর রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে লেখা এই নিবন্ধটি ‘আল-ফারাবীর দার্শনিক চিন্তাধারা’ বই থেকে সংকলিত। দর্শনের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহজাহান বইটি লিখেছেন। লেখক ১৯৭৭-৮২ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম দর্শন তথা আল ফারাবী ও আল গাজ্জালীর দর্শনের উপর ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার কাজ করেন। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আল ফারাবীর নীতিবিদ্যার উপর থিসিস রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
পাঠকদের সুবিধার্থে নাতিদীর্ঘ এই নিবন্ধটি পাঁচটি পর্বে প্রকাশ করা হলো।
প্রথম পর্ব
১) সমাজের প্রয়োজনীয়তা

মানুষ এমনভাবে সৃষ্ট যে তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে অনেক কিছুর দরকার হয়। কিন্তু সে একা সেই প্রয়োজন মেটাতে পারে না। তাই প্রয়োজনের খাতিরে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে সমাজ। বিভিন্ন প্রকার উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে বিভিন্ন ধরনের সমাজ গঠিত হয়। সমাজ যত বড় হয়, মানুষ তত বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারে। মানুষের সমাজ ঘরবাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। ধীরে ধীরে ক্রমবিকাশের ধারায় গড়ে ওঠে বস্তি, গ্রাম, শহর ও নগর। মানুষ সমাজের উন্নয়নকল্পে কাজ করে, যা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রে পরিণত হয়। রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনসমষ্টিকে জাতি (উম্মাহ) বলে আখ্যায়িত করা হয়। ভৌগোলিক পরিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ু, আচার-আচরণ এবং ভাষার ভিত্তিতে এক জাতিকে অন্য জাতি থেকে পৃথক করা যায়।

মানুষের সমাজ প্রধানত দুই প্রকার: (ক) অপূর্ণ সমাজ ও (খ) পূর্ণ সমাজ। একটি পূর্ণ সমাজ রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে। পূর্ণ সমাজ বা রাষ্ট্র আবার তিন ধরনের হতে পারে। যথা: বড়, মধ্যম ও ছোট। যখন সারা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে মানব কল্যাণের জন্যে সুসংঘবদ্ধভাবে কাজ করে তখন গড়ে ওঠে বৃহত্তম বিশ্ব রাষ্ট্র। মাঝরি ধরনের সংগঠন বা রাষ্ট্র হচ্ছে সাম্রাজ্য ও খিলাফত, যা পৃথিবীর কোনো বৃহত্তর অংশে স্থাপিত হয়। আর নগরের জনসমষ্টি নিয়ে গঠিত হচ্ছে সবচেয়ে ছোট রাষ্ট্র। গ্রাম, বস্তি বা কোনো রাজপথভিত্তিক সংগঠনকে বলা যেতে পারে অপূর্ণ সমাজ।
মানুষের জীবনে কল্যাণ অথবা অকল্যাণ মূলত তাদের ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের উপর নির্ভরশীল। যে সমাজের জনগণ প্রকৃত সুখ অর্জনের উদ্দেশ্যে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজে অগ্রসর হয় তাকে বলা হয় আদর্শ সমাজ। এই মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রকে বলা হয় আদর্শ রাষ্ট্র আর জাতিকে আদর্শ জাতি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এরূপ রাষ্ট্রে নাগরিকরা সদগুণসম্পন্ন হবার জন্যে পরস্পরকে সহযোগিতা করে এবং পরিণামে তাদের জীবন সুন্দর ও কল্যাণময় হয়ে ওঠে।
২) রাষ্ট্রপ্রধান

একথা সত্য যে সবাই নেতা হতে পারে না। শারীরিক ক্ষমতা, মানসিক শক্তি, সৎচিন্তা, সদিচ্ছা ও সৎকাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে সবাই সমান নয়। প্রতিটি পেশায়, প্রতিটি বিভাগে নেতৃত্বের প্রয়োজন। সুস্থ শরীর, মুক্ত মন, সুন্দর আচরণ, মোহনীয় ব্যক্তিত্ব, সুদূর প্রসারী কল্পনাশক্তি, সাহসিকতা, মনোযোগ, সৃজনী প্রতিভা, সঠিক নির্দেশদানের ক্ষমতা প্রভৃতি গুণাবলি যে ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান তিনিই নেতা হিসেবে পরিচিত। নেতারা প্রথম সারির লোক। তাঁদের গুণাবলি ও কার্যক্ষমতা দ্বারা জনসাধারণকে তাঁরা পরিচালিত করেন সত্যের দিকে, সুন্দরের পথে। বিভিন্ন পেশার ভিত্তিতেও নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। যেমন কৃষি, ব্যবসা, শিক্ষকতা ইত্যাদি। রাষ্ট্রপ্রধান হবেন সেই ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রের কার্য পরিচালনায় পারদর্শী। তাঁর জন্যে বিজ্ঞান এবং কলা বিষয়ক জ্ঞানের অধিকারী কোনো ব্যক্তিবিশেষের কাছ থেকে কোনো রকম দিকনির্দেশনার প্রয়োজন নেই। এসব গুণাবলির উল্লেখ দ্বারা আল ফারাবী সম্ভবত প্রধান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা) এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কল্যাণকামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান হবেন সেই ব্যক্তি যিনি নেতৃত্বের সবদিকেই পারদর্শী। আদর্শ রাষ্ট্রের মাধ্যমে সম্পূর্ণতা ও চরম শান্তি অর্জনের জন্যে তাঁর কাজ হবে সবার সেবা করা। তিনি কারও অনুগত হবেন না। তিনি হবেন সর্বগুণে গুণান্বিত। তিনি তাঁর ধ্যানে, কর্মে, জাগ্রত অবস্থায়, এমনকি নিদ্রিত অবস্থায় সক্রিয় বুদ্ধি থেকে সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। তিনি তাঁর আত্মাকে ভালো ভাবে জানেন। তিনি অর্জিত বুদ্ধির অধিকারী। অর্জিত বুদ্ধির অবস্থান হচ্ছে নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয় বুদ্ধির মাঝখানে। তিনি সাধনা বলে জাগতিক স্তর থেকে নিজেকে মুক্ত করে আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হন এবং সক্রিয় বুদ্ধি থেকে অনুকম্পা লাভ করেন। জড় থেকে মুক্তি এবং সক্রিয় বুদ্ধির অনুকম্পা এই দুইয়ের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় অর্জিত বুদ্ধি। তিনি সেই অর্জিত বুদ্ধির অধিকারী মহামানব। আল্লাহ তায়ালা সক্রিয় বুদ্ধির (হযরত জিবরাঈল (আ) কে আল ফারাবী সক্রিয় বুদ্ধি বলে উল্লেখ করেছেন) মাধ্যমে তাঁর কাছে বাণী পাঠান, মানবতার চরম শীর্ষে তাঁর স্থান, তিনি খোদার আশীর্বাদপুষ্ট। তিনি ভালোভাবে জানেন কোন পথে চললে সুখ অর্জন সম্ভব; তাঁর আত্মা হবে সমুন্নত।

৩) আদর্শ রাষ্ট্রের প্রধান শাসকের গুণাবলি
(১) সুন্দর স্বাস্থ্য, প্রফুল্ল মনের অধিকারী হওয়া এবং নিখুঁত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুষ্ঠু ব্যবহার ও অন্যান্য প্রবৃত্তির সাথে এর স্বাভাবিক সমন্বয় সাধনে সক্ষম হওয়া।
(২) এমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি বরং প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া যাতে স্থান-কালের প্রেক্ষিতে তিনি কোনো বক্তার উদ্দেশ্য বুঝতে সক্ষম হন।
(৩) এমন স্মরণশক্তির অধিকারী হওয়া যাতে করে তিনি যা দেখেন, শুনেন, বোঝেন ও প্রত্যক্ষ করেন তা স্মরণ রাখতে সক্ষম হন।
(৪) এমন বিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়া যাতে করে তিনি উদ্ভূত সমস্যার দৃষ্টিকোণ ও প্রেক্ষিত বুঝতে পারেন।
(৫) এমন বাগ্মিতা ও বাকপটুতার অধিকারী হওয়া যার মাধ্যমে তিনি তাঁর মনোভাব সঠিকভাবে ব্যক্ত করতে পারেন।
(৬) শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি অনুরাগ এবং সহজ, সরল, স্বাভাবিকভাবে ও ধৈর্য সহকারে জ্ঞান লাভের অভ্যাস।
(৭) কাজকর্মে ভারসাম্যবোধ, পানাহার ও যৌন ইচ্ছার উপর নিয়ন্ত্রণ, অত্যধিক আনন্দের প্রতি অনীহা।
(৮) সত্য গ্রহণ এবং সত্যাশ্রয়ী লোকের সাথে বন্ধুত্ব এবং মিথ্যা বর্জন ও মিথ্যাশ্রয়ী লোকের নিন্দা জ্ঞাপন করার ক্ষমতা অর্জন।
(৯) মহৎ মন, প্রশস্ত অন্তরসম্পন্ন হয়ে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে মহানুভবতা ও উদারতার অধিকারী হওয়া।
(১০) ধনসম্পদ, দিনার-দিরহাম অর্জনের প্রতি অমনোযোগী হওয়া।
(১১) প্রকৃতিগতভাবে ন্যায় এবং ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির প্রতি অনুরক্ত হওয়া এবং অন্যায় অত্যাচার ও অত্যাচারীর কাছ থেকে দূরে অবস্থান করা।
(১২) নিঃসংকোচ, নির্ভয় ও বিনা দ্বিধায় যা ভালো তা কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করার ক্ষমতা; দৃঢ় সিদ্ধান্ত, অটুট মনোবল এবং সাহসিকতা অর্জন ও প্রয়োজনবোধে জিহাদ পরিচালনার ক্ষমতা।
দ্বিতীয় পর্ব

৪) কল্যাণকামী রাষ্ট্র
যে কল্যাণকামী রাষ্ট্রে জনগণ একত্রিত হয়ে পরস্পরকে সৎকাজ সম্পাদন, সদগুণাবলি ও সুখ অর্জনে সহায়তা করে তাকে সদগুণসম্পন্ন আদর্শ রাষ্ট্র বলে। এ রাষ্ট্রে মানুষের চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে জ্ঞান এবং ভালো-মন্দ, সদগুণ, অসদগুণের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এখানে শাসক ও নাগরিক সকলেই এসব বিষয় সম্পর্কে নিজেরা জ্ঞান অর্জন করে এবং অপরকে জ্ঞান দান করে, আর সেসব চারিত্রিক সদগুণ অর্জনে তৎপর হয়, যা সুখ অর্জনে সহায়ক এবং সৎকাজের উন্মেষ ঘটায়।
কল্যাণকামী রাষ্ট্রের শাসকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত জোরালো। তাদের ধ্যান-ধারণা ও কার্যাবলি একই সূত্রে গাঁথা। একই সময়ে অনেক শাসক বিভিন্ন রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন, কিন্তু তাঁদের মৌলিক নীতিমালা বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাঁরা একতাবদ্ধ। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁরা সুসংগঠিত।
কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে রয়েছেন দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, ভাষ্যকার, প্রবন্ধকার, শিল্পী, হিসাববিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, পরিসংখ্যানবিদ, জ্যোতিষী, ডাক্তার, ব্যবসায়ী ও কৃষকশ্রেণি ইত্যাদি।
আদর্শ শাসকের গুণাবলির ভিত্তিতে কল্যাণকামী রাষ্ট্রকে চারভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
৪.১) প্রথম কল্যাণকামী রাষ্ট্র: যে রাষ্ট্রের শাসকদের মধ্যে আদর্শ শাসকের জন্য নির্ধারিত সব গুণ বিদ্যমান তাকে প্রথম পর্যায়ের কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলে।
৪.২) দ্বিতীয় কল্যাণকামী রাষ্ট্র: আদর্শ শাসকের গুণাবলি যদি একত্রে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায় এবং তাঁরা দেশ শাসন করেন তবে শাসকবৃন্দকে দ্বিতীয় পর্যায়ের আদর্শ শাসক এবং তাঁদের দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রকে দ্বিতীয় পর্যায়ের কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলে।
৪.৩) তৃতীয় কল্যাণকামী রাষ্ট্র: আদর্শ শাসকের জন্য নির্ধারিত গুণাবলি যদি দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে না পাওয়া যায়, কিন্তু এমন ব্যক্তি যদি পাওয়া যায় যার মধ্যে আদর্শ শাসকের গুণ না থাকলেও তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা থাকে, এরূপ ব্যক্তি তৃতীয় পর্যায়ের শাসক; আর এ জাতীয় রাষ্ট্র তৃতীয় কল্যাণকামী রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে শাসকের মধ্যে যে ছয়টি গুণ থাকা প্রয়োজন তা নিম্নে বর্ণিত হলো:
(ক) বিজ্ঞ দার্শনিকের মতো গুণাবলি অর্জন।
(খ) শরীয়তের নিয়ম-কানুনের উপর বিশেষজ্ঞ হওয়া এবং শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে তাঁর পূর্ববর্তী আদর্শ শাসকের মতো সুচারুরূপে সমস্যাবলি সমাধানের ক্ষমতা অর্জন করা।
(গ) নতুন পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত যেসব সমস্যা সমাধানের জন্যে শরীয়তের সরাসরি কোনো নিয়ম বর্ণিত হয়নি, সেসব সমস্যা সমাধানকল্পে নিয়ম-কানুন বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন।
(ঘ) দূরদর্শিতা এবং সমাজ সংস্কারের জন্যে গৃহীত নির্দেশাবলিকে বাস্তবে রূপদানের শক্তি।
(ঙ) সুন্দর ভাষায় শরীয়তের বিধি-বিধান জনসাধারণের কাছে হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপনের ক্ষমতা ও বলিষ্ঠভাবে বক্তব্য প্রদানের ক্ষমতা অর্জন।
(চ) সমরাস্ত্র ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ও জিহাদ পরিচালনায় পারদর্শিতা অর্জন।
৪.৪) চতুর্থ কল্যাণকামী রাষ্ট্র: আদর্শ একজন প্রতিনিধির মধ্যে নেতা হবার গুণাগুণ পাওয়া না গেলে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে যদি ঐ গুণগুলো পাওয়া যায় এবং তাঁরা যদি প্রথম আদর্শ শাসকের গুণাবলির ভিত্তিতে একত্রে মিলেমিশে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাহলে শাসকবৃন্দকে চতুর্থ পর্যায়ের আদর্শ শাসক বলা হবে এবং রাষ্ট্রকে চতুর্থ পর্যায়ের কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলা হবে।
তৃতীয় পর্ব

যেসব রাষ্ট্র কল্যাণধর্মী নয়, সেই সব রাষ্ট্রকে আল ফারাবী তিনভাগে ভাগ করেছেন। যথা–
  • অকল্যাণকামী রাষ্ট্র,
  • অনৈতিক রাষ্ট্র
  • ভ্রান্ত রাষ্ট্র

৫) অকল্যাণকামী রাষ্ট্র (আল মদীনা আল জাহেলিয়াহ)
কল্যাণকামী রাষ্ট্রের শাসক হচ্ছেন বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের উন্নতি ও সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা, যদি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র জনগণের কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হয় এবং শাসকদের রাষ্ট্র শাসনের প্রয়োজনীয় গুণাবলি না থাকে তবে সেই রাষ্ট্রকে অকল্যাণকামী রাষ্ট্র বলা যেতে পারে। তিনি অকল্যাণকামী রাষ্ট্রকে ছয় শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যথা–
  • প্রয়োজনাত্মক রাষ্ট্র
  • ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র
  • ভোগবিলাসী রাষ্ট্র
  • গৌরব-প্রত্যাশী রাষ্ট্র
  • আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র
  • গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
পরিশেষে, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মধ্যে পরগাছাধর্মী স্বার্থান্বেষী মহলের অশুভ তৎপরতা সম্পর্কে ফারাবী আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সিয়াসাতুল মাদানীয়াহর অনুসরণে আমরা প্রথমে অকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ছয়টি বিভাগ আলোচনার পরে অনৈতিক ও ভ্রান্ত রাষ্ট্র সম্পর্কে বর্ণনা দেব এবং সর্বশেষে কল্যাণকামী রাষ্ট্রে স্বার্থান্বেষী মহলের অশুভ তৎপরতা সম্পর্কে আলোচনা করব।
৫.১) প্রয়োজনাত্মক রাষ্ট্র (আল মদীনা আল জরুরীয়াহ)
যে রাষ্ট্রের নাগরিক শুধুমাত্র দেহের অস্তিত্ব সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী অর্জনে পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে, তাকে প্রয়োজনাত্মক রাষ্ট্র বলে। প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহের পথ অনেক। যেমন, কুটির শিল্প স্থাপন, শিকার, দস্যুবৃত্তি ইত্যাদি। প্রকাশ্য বা গোপনে উভয় প্রকারেই শিকার, দস্যুবৃত্তি চরিতার্থ করা যেতে পারে। কিছু প্রয়োজনাত্মক রাষ্ট্র আছে যেখানে প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের ব্যবস্থা আছে। নাগরিকদের জন্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহে পারদর্শী ব্যক্তি শাসক হিসেবে বিবেচিত হন।
৫.২) ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র (আল মদীনা আল নাযালাহ)
যে রাষ্ট্রের নাগরিক শুধুমাত্র অঢেল টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ অর্জন, সংরক্ষণ ও সঞ্চয়ের জন্যে রাষ্ট্র গঠন করে সেই রাষ্ট্রকে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে। কেবল দৈহিক চাহিদা অনুযায়ী তাঁরা খরচ করেন। সমাজের কল্যাণমূলক কাজে তাঁরা কিছুই ব্যয় করতে নারাজ। ধন-সম্পদ অর্জনে যে ব্যক্তি পারদর্শী সেই ব্যক্তি উত্তম বলে বিবেচিত। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নাগরিকদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ধন-সম্পদ অর্জনে পারদর্শী সেই উত্তম ব্যক্তি বলে বিবেচিত। যে নাগরিকদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ধন-সম্পদ অর্জন ও সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করতে পারবেন তিনিই হবেন ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসক।
৫.৩) ভোগবিলাসী রাষ্ট্র (আল মদীনা আল খাসসাহ)
যে রাষ্ট্রের নাগরিক দৈহিক ও কাল্পনিক সুখ লাভ ও আনন্দ উপভোগের উদ্দেশ্যে একে অপরকে সাহায্য করে, তাকে ভোগবিলাসী রাষ্ট্র বলে। তাঁরা খাদ্য, পানীয়, কামনা ও বাসনার তৃপ্তি সাধনের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করে থাকে। তাঁরা খেলাধুলা, আমোদ-প্রমোদে দিন কাটায়। তাঁরা মনে করেন, যে ব্যক্তির ভোগ-বিলাস ও আমোদ-প্রমোদের যত বেশি উপকরণ রয়েছে সে তত ভাগ্যবান।
৫.৪) গৌরব-প্রত্যাশী রাষ্ট্র (আল মদীনা আল কারামিয়া)
যে রাষ্ট্রের নাগরিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথা ও কাজে সম্মান অর্জন ও সম্মান প্রদানের জন্য একে অপরকে সাহায্য করে থাকে, তাকে গৌরব-প্রত্যাশী রাষ্ট্র বলে।
৫.৫) আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র (আল মদীনা আল তাগাল্লাব)
যে রাষ্ট্রের জনগণ দেশে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করার জন্য একে অপরকে সাহায্য করে, তাকে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র বলে। আধিপত্যবাদীরা বিভ্ন্নি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁদের শাসনযন্ত্র পরিচালিত করে। কারও ইচ্ছা খেয়াল-খুশি মতো রক্তপাত, কারও ইচ্ছা ভূমি জবর-দখল, আবার কারও ইচ্ছা মানুষকে দাসানুদাসে পরিণত করা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বল ও কৌশল উভয়পন্থা একসাথে প্রয়োগ করে স্বৈরশাসন পরিচালনা করে। স্বৈরাচারীরা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং বাইরের শত্রু আক্রমণের সময় সমবেতভাবে একে অপরকে রক্ষা করে। জনগণের উপর প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য যে ব্যক্তি তাঁর অধীনস্ত স্বৈরাচারী শাসকদেরকে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে সক্ষম, তিনিই হলেন যোগ্য শাসক। তিনি চিরদিন শাসক হয়ে বেঁচে থাকতে চান। কোনোদিন শাসিত হয়ে জীবনযাপন করতে রাজি নন। প্রভুত্ব বিস্তারের প্রকৃতি, সামরিক সজ্জার বহর ও যুদ্ধাস্ত্রের প্রাচুর্যকে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে বাদানুবাদ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বিবাদের সৃষ্টি হয়। এসব শাসকেরা নিষ্ঠুর, অতিরাগী, অপব্যয়ী, অতিলোভী, ভোজনবিলাসী, নেশাগ্রস্ত, কামাসক্ত হয়ে পড়ে। অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদের মালিকানা নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয় এবং সবসময় আধিপত্য বিস্তারের ফিকির-ফন্দিতে ব্যস্ত থাকে।
(১) কোনো কোনো সময় সারা দেশের জনগণ বৃহত্তর সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে অন্য দেশের উপর অধিপত্য বিস্তারের জন্য তৎপর হয়।
(২) কখনও কখনও বিজয়ী ও বিজিত উভয় দল একসাথে সমমর্যাদা নিয়ে বসবাস করে। আবার কখনও কখনও বিজয়ীরা গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে বিজিতদেরকে শোষণ করে।
(৩) কোনো কোনো সময় মাত্র একজন আধিপত্যবাদী শাসক থাকেন। আর প্রশাসন পরিচালনার জন্যে তাঁর সাথে থাকে কিছু সহচর। তিনি এসব সহচরের মাধ্যমে দেশ শাসন করেন। দেশ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ দিয়ে তিনি বিলাসী জীবনযাপন করেন এবং সহচরদের ধনসম্পদ অর্জনের সুযোগ দেন। আর দেশের জনসাধারণ শাসকের ইচ্ছানুযায়ী বসবাস করেন। তাঁরা বিনয়ী কিন্তু অবহেলিত। তাঁদের নিজের বলতে কিছুই নেই। তাঁদের কেউ চাষী, কেউ বা ব্যবসায়ী। তাঁরা শাসকহীন মনোবৃত্তির বশীভূত হয়ে জনগণকে শোষণ করে আনন্দ লাভ করেন। আর নাগরিকদের তাঁরা অবদমিত, বিনীত ও নম্র অবস্থানে দেখতে চান; স্বাধীনচেতা ও মহৎ মনের মানুষ সৃষ্টি করা তাঁর কাজ নয়। নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে শাসকেরা সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নতি কামনা করে না।
চতুর্থ পর্ব

৫.৬) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (আল মাদীনাতুল জামাআইয়া)
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হচ্ছে সেই রাষ্ট্র যেখানে মানুষের রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা, নাগরিকরা সবাই সমান। কোনো দিক দিয়েই একজন অন্যজন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর হতে পারে না। ফলে গড়ে ওঠে বিভিন্নধর্মী মনমানসিকতা, জন্ম নেয় নানা ধরনের নৈতিক প্রবণতা, এতেই মানুষ আনন্দ লাভ করে। নাগরিকেরা অসংখ্য দলে উপদলে বিভক্ত। সম্ভ্রান্ত ও অসম্ভ্রান্ত সব গোষ্ঠীর মিলনস্থল এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে শাসক ও শাসিতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই । বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাসিতরাই শাসকদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে। অবশ্য যেসব নেতৃবৃন্দ জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষণ করে, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়তা করে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের সময় নিরাপত্তা বিধান করে, নাগরিকেরা সেসব নেতৃবৃন্দের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
আদর্শচ্যুত রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুরোপুরিভাবে বিদ্যমান। আদর্শচ্যুত রাষ্ট্রের মধ্যে তুলনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি শান্তিপূর্ণ। তাই তা প্রশংসার দাবিদার। আপাতদৃষ্টিতে কারুকার্যখচিত চাকচিক্যময় পোশাকের মতোই মনে হয়। সবাই গণতান্ত্রিক দেশে বসবাসে আগ্রহী। কেননা, গণতান্ত্রিক দেশে সবার মনের বাসনা পূরণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অন্য দেশের নাগরিকেরা সেখানে সুখে-শান্তিতে বসবাসের আশায় ভিড় করে এবং আশাতীতভাবে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন জাতির আগমন ও বহুমুখী শিক্ষার সংমিশ্রণে বৈচিত্র্যময় মনমানসিকতার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্থায়ী বাসিন্দা এবং বহিরাগতদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই মিলেমিশে একসাথে বাস করে। জীবনধারণের উপকরণ সেখানে সহজেই অর্জন করা যায়। এই পরিবেশে কালক্রমে সদ্গুণসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আবির্ভাব খুবই স্বাভাবিক। আর সেখানে বসবাস করবে দার্শনিক, অলংকারশাস্ত্রবিদ, কবি-সাহিত্যিকদের মতো জ্ঞানীগুণী সুধীজনবৃন্দ। এখান থেকে আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য কিছু মহৎ ব্যক্তি বাছাই করা যেতে পারে। অতএব, দোষগুণের সমাহারে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্র যত বড় সে রাষ্ট্র তত বেশি সভ্য, জনবহুল, উৎপাদনশীল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানে সৎ ও অসৎ উভয় প্রকার লোক সমভাবে বিদ্যমান।
আদর্শচ্যুত রাষ্ট্র যেমন নৈতিকতা বিবর্জিত, আদর্শহীন নেতৃত্বও তেমনি নীতি বর্জিত। আদর্শহীন নেতৃত্বের উদ্দেশ্য হলো জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ, আনন্দ উপভোগ, সম্মান, খ্যাতি, প্রশংসা, আধিপত্য অথবা অবাধ স্বাধীনতা অর্জন। অতএব, এ জাতীয় নেতৃত্ব টাকা দিয়ে কেনা যায়। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসকদের পদমর্যাদার ক্ষেত্রে এ নীতি অধিক প্রযোজ্য। কেননা, এই রাষ্ট্রে পদমর্যাদার দিক থেকে সবাই সমান। কেউ কারো চেয়ে বড় নয়। গণতান্ত্রিক দেশে শাসকেরা নাগরিকদের অনুকম্পায় তাঁদের পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। এর বিনিময়ে তাঁরা নগদ টাকা কিংবা মূল্যবান ব্স্তু দিয়ে নাগরিকদের খুশি রাখেন। জনগণের দৃষ্টিতে আদর্শ নেতা হচ্ছেন এমন ব্যক্তি যার সঠিক বিচারক্ষমতা রয়েছে এবং তিনি সুপরিকল্পিত উপায়ে এমনভাবে দেশ শাসন করবেন যেন তাঁদের সব ইচ্ছাই পূরণ হয়, সদা-সর্বদা শত্রুর কবল থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারেন ও জানমালের নিরাপত্তা থাকে। যদি কোনো আদর্শ ব্যক্তি তাঁদের নেতা হন এবং সার্বিক সুখ লাভের চেষ্টা করেন, তবে জনগণ তাঁকে প্রশাসকের পদে অধিষ্ঠিত করতে নারাজ। এসব শাসক নাগরিকদের হাতে নিহত হন বা ক্ষমতাচ্যুত হন অথবা সবসময় তাঁর জানমালের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন থাকে। এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ও অন্যান্য রাষ্ট্রের অবস্থা একইরূপ। কেননা, সব আদর্শচ্যুত রাষ্ট্রের নাগরিকরা এমন শাসক কামনা করেন যাঁরা তাঁদের ইচ্ছাপূরণ ও স্বার্থসিদ্ধির পথ সুগম করে দেন। তাই তারা মহৎ লোকের শাসন বর্জন করেন। তবুও একথা স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, অন্যান্য আদর্শচ্যুত রাষ্ট্রের তুলনায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মাধ্যমে আদর্শ রাষ্ট্রে উত্তরণ ও আদর্শ শাসকের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সহজ ও ফলপ্রসূ। তাই আদর্শ রাষ্ট্রের পরই গণতন্ত্রের স্থান।
অকল্যাণকামী রাষ্ট্রের নাগরিকরা মানবিক কল্যাণকে সম্মানের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে না। তাঁদের মতে সম্মানের মানদণ্ড হলো:
(ক) সম্পদ
(খ) খেলাধুলা ও আনন্দদানের উপকরণ লাভের ক্ষমতা
(গ) জীবন চলার পথে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী অর্জন
(ঘ) অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা।
শেষোক্ত বিষয়টিকেই অধিকাংশ লোক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এমনকি আধিপত্য বিস্তারের শক্তি এবং অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে থাকে। অতএব, জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার ও রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা অকল্যাণকামী রাষ্ট্রে একটি বিশেষ গুণ হয়ে থাকে। কেননা, তাঁদের দৃষ্টিতে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে রাষ্ট্রে খ্যাতি অর্জন করা যায়। আর এই খ্যাতির ব্যাপ্তির উপর নির্ভর করে সম্মানের প্রসার। আর আধিপত্যের মাত্রা নির্ণীত হয় তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ও শক্তির ভিত্তিতে। যাঁর অনুসারীর সংখ্যা ও শক্তি যত বেশি তিনি তত সম্মানের পাত্র। যাঁর শক্তিশালী সমর্থক রয়েছে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষের ক্ষতি সাধন করতে পারেন অতি সহজে। যে ব্যক্তি মানুষের যত বেশি ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম সমাজের লোকেরা তাকে সম্মান করে তত বেশি।
অকল্যাণকামী রাষ্ট্রের নাগরিকেরা কোনো কোনো সময় বংশগত ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের ধ্বজাধারী ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। কেননা, অভিজাত পরিবারের বংশধরদের ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সমর্থক থাকে। তাই জনগণ তাঁদেরকে সম্মান প্রদর্শন করে এই আশায় যে, বিনিময়ে কিছু সম্মান ও অর্থসম্পদ লাভ করা যাবে। অকল্যাণকামী রাষ্ট্রের নাগরিকরা মনে করেন যে, তাঁদের দৃষ্টিতে যাঁরা বেশি সম্মানিত তাঁরা হবেন শাসক, আর যাঁরা কম সম্মানিত তাঁরা হবেন শাসিত। ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বংশগত ঐতিহ্য ও আভিজাত্যহীন লোকের শাসক হবার কোনো যোগ্যতা নেই।
কোনো কোনো সময় শাসককে সম্মান করা হয় এজন্য যে, তিনি নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, ধনসম্পদ ও আনন্দের উপকরণ সরবরাহ করতে সক্ষম এবং তিনি তার প্রশাসনের মাধ্যমে নাগরিকদের সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এ ধরনের শাসককে জনগণ পছন্দ করেন। কেননা, তিনি জনগণের জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বিনিময়ে তিনি চান যে, তাঁর জীবদ্দশায় লোকে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুক এবং মৃত্যুর পরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করুক।
তিনি সম্মান লাভের আশায় ধনসম্পদ অর্জন করেন। এই জন্যেই কোনো কোনো শাসক দানশীল হন। তাঁরা একদিকে রাষ্ট্র থেকে কর আদায় করেন এবং অন্যদিকে তা জনগণের স্বার্থে খরচ করেন।
কোনো কোনো সময় শাসকেরা চান যে, তাঁর প্রতি এই সম্মান বংশ পরম্পরায় বজায় থাক এবং তাঁর সন্তান-সন্ততি পরবর্তীকালে সম্মান লাভ করুক। তাই কোনো কোনো শাসক জনসাধারণের কথা চিন্তা না করে ভবিষ্যতে তাঁর নিজের ও বংশের সম্মান লাভের আশায় অর্থ সঞ্চয় করেন। শাসকেরা কোনো কোনো দল উপদলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এই আশায় যে, তাঁরা বিনিময়ে শাসকদেরকে সম্মান প্রদর্শন করবেন এবং কোনো দল বা উপদলকে সন্তুষ্ট করতে যে সম্পদ ও আনন্দ-উপকরণ প্রভৃতি দরকার তা সরবরাহ করে থাকেন। তাঁরা জৌলুস বৃদ্ধির জন্য কারুকার্যখচিত ঐশ্বর্যমণ্ডিত এমন দালান-কোঠা নির্মাণ করেন, যেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। আর তাঁর নিজের ও পরিবারের জন্য তিনি মহামূল্যবান পোষাক ও পদক তৈরি করেন। উপরন্তু তিনি এমনসব আইন প্রণয়ন করেন যাতে বংশানুক্রমে তার সন্তান-সন্ততিরা সেই সম্মনের ভাগী হয়। তাছাড়া, তিনি সেই সমস্ত লোকদের সুযোগ-সুবিধা দান করেন যাঁরা তাঁর সম্মান রক্ষার জন্য কাজ করে থাকেন। তাঁর সম্মান রক্ষার্থে নাগরিকদের মধ্যে যিনি যতটুকু কাজ করেন তাঁকে ততটুকু সুবিধা প্রদান করেন। অপরপক্ষে নাগরিকরা ততক্ষণ পর্যন্ত শাসককে সম্মান প্রদর্শন করেন যতক্ষণ তিনি তাঁদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেন। গৌরব-প্রত্যাশী রাষ্ট্র অকল্যাণকামী রাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে ভালো, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মতো। তবে যখন সম্মন গ্রহণ ও প্রদানের আশা মাত্রাতিরিক্ত হয় তখন তা স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যা ধীরে ধীরে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে পরিবর্তিত হয়।
৬) অনৈতিক রাষ্ট্র (আল মদীনা আল ফাসেকাহ)
যে রাষ্ট্রের নাগরিকরা সত্তার অস্তিত্ব ও নীতিমালায় (প্রথম কারণ, দ্বিতীয় কারণ, সক্রিয় বুদ্ধি, কার্যকারণ সম্পর্ক, জড়পদার্থ ও আত্মা) বিশ্বাস করে শান্তির প্রকৃতি ও সুখ অর্জনের পন্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও ঐ সব নীতিমালার উপর আমল করে না এবং ইহকাল ও পরকালে সুখ কামনা করে না, সেই রাষ্ট্রকে অনৈতিক রাষ্ট্র বলে। ঐ রাষ্ট্রের নাগরিকরা অকল্যাণকামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের মতো ধন-সম্পদ আহরণ, সম্মান অর্জন ও আনন্দ উল্লাসে মত্ত থাকে। অকল্যাণকামী রাষ্ট্রের নাগরিক এবং অনৈতিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের কার্যাবলি প্রায় একই রকম। তাঁদের মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে, অকল্যাণকামী রাষ্ট্রের নাগরিকরা সত্তার অস্তিত্ব ও নীতিমালায় বিশ্বাস করে না, অপরপক্ষে অনৈতিক রাষ্ট্রের নাগরিকরা এসব নীতিমালায় বিশ্বাসী। অবশ্য, একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, অকল্যাণকামী রাষ্ট্র এবং অনৈতিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের কেউই সুখ অর্জনে সক্ষম নয়।
৭) ভ্রান্ত রাষ্ট্র (আল মদীনা আল দাল্লাহ)
যে রাষ্ট্রের নাগরিকরা সুখ অর্জনের প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা উপেক্ষা করে শুধুমাত্র ধারণার বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে, সেই রাষ্ট্রকেই ভ্রান্ত রাষ্ট্র বলে। ভ্রান্ত রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্রকৃত সুখ অর্জন সম্ভব নয়।
শেষ পর্ব

৮) কল্যাণকামী রাষ্ট্রে স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতাআদর্শ রাষ্ট্রে বিভিন্ন শ্রেণির অবাঞ্ছিত ব্যক্তির আনাগোনা দেখা যায়। আল ফারাবী এসব লোককে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের আগাছা বলে উল্লেখ করেছেন। আগাছা যেমন একটা সুন্দর প্রাণবন্ত চারাগাছের স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায় তেমনি রাষ্ট্রে আগাছাধর্মী এসব অবাঞ্ছিত ব্যক্তি কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। তাদের মধ্যে –
(ক) এক শ্রেণির লোক আছে যাদের কার্যাবলি রাষ্ট্রের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে সহায়ক। কিন্তু তারা সম্মান, শাসনক্ষমতা ও ধনসম্পদ অর্জনের জন্য এসব কাজ করে থাকে। এরা হচ্ছে সুবিধাবাদী দল।
(খ) কেউ কেউ আদর্শচ্যুত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি অনুরাগী। যখন তাদেরকে রাষ্ট্রীয় আইন বা ধর্মীয় বিধিবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়ে থাকে, তখন তারা স্বপক্ষ সমর্থনের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ঐসব বিধিবিধানের ভুল ব্যাখ্যা করে। এই শ্রেণির লোক অপব্যাখ্যাকারী হিসেবে পরিচিত।
(গ) এমন কিছু সংখ্যক লোক আছে যারা সুখ অর্জন ও তার মূলনীতি সম্পর্কে শুধু কল্পনা করতে পারে, কিন্তু তা যথাযথভাবে অনুধাবনে অক্ষম। অতএব, তারা সত্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না। তাদের ভ্রান্ত অনুমানের ফলশ্রুতিতে সত্যদর্শীকেও তারা অসত্যবাদী প্রতারক বলে আখ্যায়িত করে। এমনকি তারা এমন ধারণাও পোষণ করে যে, যেসব ব্যক্তি সত্যের অনুসন্ধান করে তারা ভ্রান্ত।
(১) তাদের কেউ কেউ বলে যে, প্রতিটি বস্তুর মধ্যে জটিলতা রয়েছে।
(২) তাদের কেউ কেউ চিন্তা করে যে, সত্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয় এবং যারা সত্যের অনুসন্ধান করছে বলে দাবি করে তারা প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা কথা বলে। কেননা সত্য সম্পর্কে তারা যা ভাবে, তা সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু বলতে পারে না।
(৩) তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই চিন্তা করে যে, প্রতিটি ব্যক্তির সম্মুখে যা প্রতিভাত হয় তাই সত্য, সে যা চিন্তা করে তাই সঠিক।
(৪) কেউ কেউ এই চিন্তা করে যে, আসলে সত্যের বাস্তব আস্তিত্ব রয়েছে, কিন্তু তা এ পর্যন্ত অনুকরণ করা সম্ভব হয়নি।
(৫) কেউ কেউ এই ধারণা পোষণ করে যে, সত্যের বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে এবং সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তিরা সত্য অনুধাবনে সক্ষম। কিন্তু তারা (আগাছাধর্মী ব্যক্তিবর্গ) এই সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। কেননা, তারা মনে করে সত্য অনুধাবনের জন্য যে কষ্ট, পরিশ্রম ও সাধনার প্রয়োজন, সেসব প্রয়োজনীয় গুণাবলি তাদের নেই, অথবা তারা আনন্দ-উল্লাসে বিভোর বিধায় শক্তি থাকা সত্ত্বেও এই সুদূর পথপরিক্রমা ও কঠোর সাধনার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। পরিণামে তারা সত্যাদর্শী লোকদের ভণ্ড, মিথ্যাবাদী, পদলোভী ও স্বার্থান্বেষী বলে আখ্যায়িত করে। তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং অনুতাপ করে, কিন্তু এমন কোনো বিজ্ঞানসম্মত পথের সন্ধান পায় না, যা তাদের সত্যপথ প্রাপ্তির সহায়ক হয়। তারা তখন হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় স্থুল আনন্দ লাভের নেশায় ছুটে বেড়ায় এবং রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের বিশৃংখলার সৃষ্টি করে। এসব হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি আনন্দ-উল্লাসে বিভোর হয়ে জীবনের দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকতে চায়। তারা সমাজের কোনো কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে না।
এই হলো আগাছাধর্মী ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন শ্রেণির বর্ণনা। তাদের গুণাবলি দিয়ে কোনো আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কিংবা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হতে পারে না।
কল্যাণকামী রাষ্ট্রের আদর্শ শাসকের উচিত এসব অবাঞ্ছিত ব্যক্তির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা। তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রাখার জন্য এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যা তাদের পরিশুদ্ধিকরণে সহয়ক হয়। যেমন, (ক) রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা, (খ) শাস্তি প্রদান, (গ) কারাগারে আটক রাখা, (ঘ) সৎকাজ সম্পাদনে বাধ্য করা ইত্যাদি।
উপসংহারফারাবীর রাষ্ট্রদর্শন রচনার পদ্ধতি অনন্য। ভাষা বলিষ্ঠ ও তাৎপর্যপূর্ণ। জোরালো যুক্তি রয়েছে, পুনরাবৃত্তি নেই। ক্ষেত্র বিশেষে গ্রিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেও ইসলামের মৌলিক ভাবধারাপুষ্ট। ফারাবীর রাষ্ট্রদর্শনে প্লেটোর প্রভাবের চেয়ে ইসলামের প্রভাবই বেশি। এ প্রসঙ্গে রিচার্ড ওয়ালযার যথার্থই বলেছেন:
“It is obvious that Al-Farabi did not intend to proclaim a Utopian philosopher king by taking up Plato’s programme of a perfect state under philosophical rule. He did not mean to compose a philosophical novel, but he rather had in mind the contemporary caliphate, the specific type of supreme rule which Islam had in mind the contemporary caliphate, the specific type of supreme rule which Islam had brought into existence and gradually developed.”
ফারাবী রাষ্ট্রপ্রধানকে ইমাম হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং ইমাম ও রাসূলকে একই সূত্রে গেঁথে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাসূলের কথাও বলেছেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য কতগুলো গুণাবলি নির্ধারণ করেছেন এবং সেই গুণাবলির অভাব দেখা দিলে সদগুণসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ সমষ্টিগতভাবে যাতে দেশ শাসন করতে পারেন, তার বিধান রেখেছেন। প্রজ্ঞা, প্রত্যাদেশ ও অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর অভিমত বাস্তবসম্মত। এই পৃথিবীতে এর দৃষ্টান্ত আছে। হযরত মুহাম্মদ (সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে এমন রাষ্ট্র ছিল। চেষ্টা করলে এখনও এ জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ই আই জি রোজানথাল বলেন, ফারাবী মানুষের কল্যাণের জন্য যে কথা বলেছেন তা একমাত্র ইসলামী অনুশাসন অর্থাৎ শরীয়াহর মাধ্যমে সম্ভব। রোজেনথালের ভাষায়, “This happiness is guaranteed by Shariah alone”। নৈতিকতা ও অধিবিদ্যার ভিত্তির উপর ফারাবীর রাষ্ট্রদর্শন রচিত ও প্রতিষ্ঠিত। তিনিমদিনাতুল ফাজীলাহ এবং সিয়াসাতুল মাদানীয়াহ গ্রন্থ দুটোর শুরুতেই রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যেমন– খোদার অস্তিত্ব, খোদার গুণাবলি, ঐশীবাণীর প্রকৃতি, কার্যকারণ সম্পর্ক, বিশ্বসৃষ্টি প্রক্রিয়া, পৃথিবীতে মানুষের মান ও অবস্থান, কল্যাণকামী সমাজ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। মানবিক গুণাবলির পূর্ণ বিকাশ ও মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠা এবং সার্বিক শান্তি অর্জন একমাত্র রাষ্ট্রের মাধ্যমেই সম্ভব। অসীমের সাথে সসীমের সংযোগ সাধন করে, ইহকাল ও পরকালের শান্তি অর্জনের জন্য কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠন ও বাস্তবায়নের প্রতি তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রাষ্ট্র গঠনে মাতৃভাষার ভূমিকা, প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব প্রভৃতির কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
মানুষের প্রকৃতি, মানবজীবনের উদ্দেশ্য, উদ্দেশ্য সাধনের উপায়, সমাজ ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিকাশ, মানবজাতির সার্বিক কল্যাণ, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের স্বরূপ, আদর্শচ্যুত রাষ্ট্রের শ্রেণিবিন্যাস, নেতা ও নাগরিকের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যপরায়ণতা সম্পর্কে তিনি যে রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন তা বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত। শুধু যশখ্যাতি, ধনসম্পদ ও স্থুল আনন্দলাভ যাদের উদ্দেশ্য, তারা মানুষের কল্যাণ সাধন করতে পারে না। তিনি কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের অন্তরায় পরগাছাধর্মী কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য জোরালো বক্তব্য পেশ করেন। তাঁর মতে, কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কল্যাণকামী নেতা ও জাগ্রত জনতা উভয়েরই প্রয়োজন। প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে তাঁর প্রভাব ছিল অসামান্য। ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন, মাইমুনিডীস, থমাস একুইনাস, হবস, জামাল উদ্দিন আফগানী, শেখ মুহাম্মদ আবদুহ ও ইকবাল তাঁর রাষ্ট্রদর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। উর্দু, ফার্সী, তুর্কি, ল্যাটিন, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশ, এমনকি রুশ ভাষায় ফারাবীর রাষ্ট্রদর্শনের উপর বহু প্রবন্ধ রচিত হয়েছে এবং তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ কথা অনুমান করা যেতে পারে যে, রাষ্ট্রদর্শনে আল ফারাবীর অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও প্রশংসিত।
source: https://cscsbd.com/1169/5

Post a Comment

Previous Post Next Post