আবুল ফজল এর ইতিহাস

শেখ আবুল ফজল

Image result for আবুল ফজল ১৫৫১

বাঙালি সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা শেখ আবুল ফজলের লেখায় ও কর্মে দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছিল। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একজন খ্যাতনামা অধ্যাপক নোমান আহমদ সিদ্দিকি শেখ আবুল ফজল সম্পর্কে বলেন, ‘ভারতের ইতিহাস নিয়ে তাঁর নব দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘস্থায়ী মূল্য বহন করে। মোগল সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতি জনপ্রিয় করতে এর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ছিল। রাজকীয় আধিকারিক ও হিন্দু সামন্তদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের ওপরও এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছিল। শেষ অবধি আবুল ফজল কৃত ভারতীয় ইতিহাসের ধর্মনিরপেক্ষ ভাষ্য জমিতে শেকড় পেয়েছিল।’

বাঙালি মুসলমান কেবল মুক্তচিন্তা বা স্বাধীনচিন্তাকে ভয় পায় তাই নয়। মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে রীতিমতো সংগ্রামও করেছে এবং এখনও অব্যাহত রেখেছে। শেখ আবুল ফজল ও তাঁর মহান মুক্তচিন্তাকে গ্রহণ করতে বাঙালি অপারগ ছিল। আবার বলা যায় তাঁর প্রতি মোল্লাতন্ত্রও বিরাগভাজন ছিল। অথচ পশ্চিম, মানে ইউরোপ, শেখ আবুল ফজলকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছে— সমাদর করেছে। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক খালিক আহমদ নিজামি বলেন, ‘আবুল ফজলের প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক রচনা ‘আকবরনামা’ এবং তারই সম্পূরক ‘আইন-ই-আকবরি’ সমগ্র ফারসি ঐতিহাসিক সাহিত্যের মধ্যে উত্কৃষ্টতম কয়েকটির অন্যতম। ভিনসেন্ট এ. স্মিথ উল্লেখ করেছেন, এটা আসলেই অতুলনীয়, এশিয়াতে আদৌ এরকম কোনো কিছু লেখা হয় নাই এবং এমনকি ইউরোপও এমন ধরনের প্রামাণিক সংকলন খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।’মোগল সম্রাট মহামতি আকবরের সময়ে সমগ্র দেশের শাসনপদ্ধতি পরিবর্তিত হয়। আচারব্যবহার, আহারবিহার, সংগীত, শিল্পকলা ও জীবন উপভোগের উপকরণেও লাগে পরিবর্তনের ছোঁয়া। মুসলমানদের আগমন ও শাসনের ফলে সমগ্র ভারতীয় সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়। উত্তর ভারত পায় সংগীত, স্থাপত্য, চিত্রকলা ও অভিজাত জীবনচেতনা আর তুলনামূলকভাবে লাভবান হয় বাংলাদেশ। সে পায় মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা ও বিকাশের সুযোগ। বাংলা সনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় মহামতি সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক। আর শেখ আবুল ফজল বাংলা সন প্রসঙ্গে তাঁর ‘আকবরনামা’ বইতে বলেছেন যে, ‘হিজরি বর্ষপঞ্জির ব্যবহার ছিল কৃষক শ্রেণির জন্য একটি ক্লেশকর ব্যাপার। কারণ চন্দ্র ও সৌরবর্ষের মধ্যে ১১/১২ দিনের ব্যবধান এবং এ কারণে ৩১ চান্দ্রবর্ষ ৩০ সৌরবর্ষের সমান ছিল। সে চান্দ্রবর্ষ অনুয়ায়ী রাজস্ব আদায় করা হতো তবে ফসল সংগ্রহ করা হতো সৌরবর্ষ অনুযায়ী। ফলে খাজনা আদায়ের ব্যাপারে অসুবিধায় পড়তে হতো। এ সকল অসুবিধার কথা সম্রাট আকবরের নবরত্ন ও অন্যান্য সভাসদগণের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সভাসদদের আলোচনার ভিত্তিতে মোগল সম্রাট আকবর সৌর মাসভিত্তিক বর্ষ গণনার কথা চিন্তা করেন। সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বকালের ২৯তম বর্ষে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্যাপকভাবে সর্বত্র ১লা বৈশাখ ফসলি সনের প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে এ ফসলি সনই বাংলা সনে পরিণত হয়।  শেখ আবুল ফজল বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ হিসেবে সম্মানিত হবার মূল কারণ তাঁর রচনায় বৌদ্ধিক উপাদানের সর্বব্যাপী উপস্থিতি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিবর্তনে সর্বদাই যুক্তির পক্ষে তাঁর আবেদন। ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি, সে যুগের রাজনৈতিক ও প্রসাশনিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক ইতিহাস ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা, নতুন পদ্ধতিবিদ্যা যা তিনি গৃহীত কর্তব্যে প্রয়োগ করতে মনস্থ করেছিলেন এবং গদ্য রচনায় তাঁর অনন্য আশ্চর্যসুলভ শৈলী। সবশেষে, ঐতিহাসিকের ভূমিকায় তাঁর সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ কীর্তি হলো ‘আকবরনামা’ এবং ‘আইন-ই-আকবরি’।ইতিহাসবিদ্যা মধ্যযুগীয় ভারতে চিন্তাবিদ, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ আকর্ষণের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। তাঁরা এটাকে স্বগুণে স্বতন্ত্র একটি বিদ্যাবিভাগ হিসেবে লালন ও চর্চা করতেন। তাঁদের কেউ কেউ, যেমন জিয়া উদ-দিন বারানি, নিজাম-উদ-দিন আহমদ, মোল্লা আবদুল কাদির বদাউনি, মুহাম্মদ কাসিম ফেরেশতা এবং কাফি খান বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মধ্যযুগীয় ইতিহাস রচনার বিশেষ অবদান রেখেছেন। ইতিহাস রচনায় পূর্বানুসৃত ঐতিহ্য তাঁদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। তবে তাঁদের একেক জনের শিক্ষার ধারা লব্ধ শিক্ষা, সামাজিক অবস্থিতি এবং ধর্ম ও রাজনীতির প্রতি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র হওয়ায় তাঁরা নিজস্ব পন্থায় ইতিহাসবিদ্যায় দৃষ্টিপাত ও একে বিচার করতেন। তাহলেও এঁদের মধ্যে শেখ আবুল ফজল এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন এবং মধ্যযুগীয় ভারতে ইতিহাসমূলক রচনার ধারায় তাঁর চিহ্ন রেখে গেছেন।হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন যে বর্ণিত যুগের ভাবনাকে, বারানি ও বদাউনি অধিকতর উত্তমরূপে ধরে রেখেছেন। সেভাবে নিজাম-উদ-দিন ও ফেরেশতা সফলতর ঐতিহাসিকের স্থান পেতে পারেন কারণ তাঁরা পক্ষপাতহীনভাবে বিষয়বস্তুর দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং অধিকতর বাস্তবসম্মত পথে ও স্বচ্ছ ভঙ্গিতে ঘটনাবলি নথিভুক্ত করেছেন। সকলেই সহজেই স্বীকার করেন যে কাফি খান সমাজে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং এই দুইয়ের ভেতর গড়ে ওঠা সম্পর্ক উপলব্ধি ও নথিভুক্ত করার জন্যে ন্যায়সম্মতভাবে কৃতিত্বের দাবিদার। শেখ আবুল ফজল হয়তো ঐতিহাসিকরূপে এসব গুণের অভাবী, তবে তিনি ব্যতীত অন্য কোনো মধ্যস্থানীয় ঐতিহাসিক যুক্তিনিষ্ঠ ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ইতিহাস বিচার এবং নতুন পদ্ধতি প্রণালি প্রয়োগ করে তথ্য সংগ্রহ, সেসবকে পর্যালোচক দৃষ্টিতে যাচাই করে সাজানো ও সংকলনের দাবি করতে পারেন না। এসব ইতিহাসমূলক রচনায় শেখ আবুল ফজলের বিশেষ মুন্সিয়ানার বিশিষ্ট লক্ষণ।সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে বিপুল তথ্য নথিভুক্ত এবং প্রশাসনিক বিধিব্যবস্থা ও বিভিন্ন প্রদেশের ভূ-প্রকৃতি সংক্রান্ত বিবরণ সম্বলিত কয়েকটি পরিচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করে তিনি ইতিহাসের পরিসর প্রসারিত করেছেন। কঠিন পরিশ্রমে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাদান সংগ্রহ এবং সযত্নে অনুসন্ধান ও যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি বাছাই করে তারপর তিনি তাদের সুস্পষ্ট ও সুশৃঙ্খল উপায়ে উপস্থাপন করতেন। একটি উেসর বৈধতা নিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন এবং ঐতিহাসিক অনুসন্ধান সম্পর্কে তাঁর উদ্ভাবিত শর্তসমূহ পালিত হলে তবেই তিনি সেই উত্সকে গ্রহণ করতেন। তাহলে, এই অভিমত দান করা যায় যে শেখ আবুল ফজলের রচনায় আমরা ইতিহাস বর্ণন অর্থাত্ ইতিহাসের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য তার ব্যাখ্যার নীতিসূত্র, তথ্য-উপাদান সংগ্রহ এবং নির্বাচনের জন্যে একটি জিজ্ঞাসামূলক পদ্ধতি সমষ্টি বিষয়ে নির্দিষ্ট ধারণা লাভ করতে পারি।শেখ আবুল ফজলের জন্ম ১৫৫১ সালের ১৪ জানুয়ারি আগরার যমুনা তীরে রামবাগে। সেকালে যা চারবাগ নামে পরিচিত ছিল। তাঁর বাবা শেখ মুবারক তাঁর সময়ের একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিত এবং সেইসঙ্গে উদার চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। শেখ মুবারকের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনযাপনের মধ্যেই তাঁর শৈশব কেটেছে। তিনি ‘আকবরনামা’র তৃতীয় খণ্ডে নিজের প্রথম জীবনের কিছু কথা লিখেছেন। বলেছেন, “এক-সওয়া এক বছরের মধ্যে আল্লাহর রহমতে আমার মুখে আরও পরিষ্কার কথা ফুটতে শুরু করল। পাঁচ বছর বয়সেই অলৌকিক প্রতিভার জানালা খুলে গেল। এমন সব কথা আমার বোধগম্য হতে থাকে যা অন্য কারো কপালে জোটে নাই। পনেরো বছর বয়সে আমি পূজনীয় পিতার জ্ঞানভাণ্ডারের খাজাঞ্চি এবং তত্ত্বরত্নের পাহাদার বনে গেলাম। কোষাগারে আসনপিঁড়ি হয়ে বসলাম। শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনার জন্যে আমায় মন সর্বদা উত্সুক হয়ে থাকত। তুচ্ছ সাংসারিক কাজকর্মের কথা শুনলে মন শত যোজন দূরে বিক্ষিপ্ত হতো। প্রায়ই কিছু বুঝে ওঠতে পারতাম না। বাবা নিজের মতো করেই আমাকে পড়াতেন, কানের কাছে জ্ঞানের মন্ত্র আওড়াতেন। প্রত্যেক বিষয়ে এক-একখানা বই লিখে মুখস্থ করাতেন। যদিও জ্ঞান বাড়ছিল, তথাপি মন বসছিল না। কখনো কখনো কিছুই মাথায় আসত না, কখনো সংশয় পথ অবরোধ করে দাঁড়াত, ভাষার বাণী সাহায্য করত না, অবরোধ সামান্য হালকা করে দিত মাত্র। বক্তৃতাতেও আমি পারদর্শী ছিলাম, তবে মুখে কথা যোগাত না। লোকজনের সামনে আমার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসত, নিজেকেই ধিক্কার দিতাম।শেখ আবুল ফজল আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। নাম-ধাম যাই হোক তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ভারতীয়। গায়ের রঙও ছিল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। তিনি বলতেন— ফর্সাদের হূদয় কালো হতে পারে তবে আমার গায়ের রঙ কালো হলেও হূদয় সাদা।’ তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল। সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঘরে দারিদ্র্যের সীমা-পরিসীমা ছিল না তবে শেখ আবুল ফজল বুঝতে পারতেন না তাঁর ক্ষিদে পেয়েছে না পেট ভর্তি। যখন পড়ালেখায় মন দিতেন তখন যেন দশ বছরের জন্যে সমাধিস্থ হয়ে যেতেন। দুই-তিন দিন পর্যন্ত তাঁর খাওয়ার কথা খেয়াল থাকত না; জ্ঞানের ক্ষুধার সামনে পেটের ক্ষুধা বেমালুম ভুলে যেতেন। তখনও তিনি বালকমাত্র। তবুও আলিমদের কথাবার্তা শুনে তাঁর সংশয় দেখা দিত। তাঁরা পরস্পরের কাছে নিজেদের মত প্রকাশ করতেন, শিশু ভেবে তাঁর দিকে মনোযোগ দিতেন না। শেখ আবুল ফজলের মন তিক্তবিরক্ত হয়ে ওঠত। তাঁর সৌভাগ্য ছিল যে শেখ মুবারকের মতো বাবা পেয়েছিলেন, তিনি সংশয়কে অহেতুক মনে করতেন না।শেখ আবুল ফজল ছিলেন বাণীর বরপুত্র। এমন বাণী ও লেখনীর খুব প্রয়োজন ছিল সম্রাট আকবরের। তিনি লিপি বিভাগে শেখ আবুল ফজলকে কাজ দিয়েছিলেন এবং ‘সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অভিযানের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করারও ভার দিয়েছিলেন তাঁর ওপর। সম্রাট আকবরের দরবারে আসার চার বছর পরে ৯৯৩ হিজরিতে (১৫৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দে) শেখ আবুল ফজলের অনেক উন্নতি ঘটে। সেই সময় তিনি এক হাজারী মনসব লাভ করেন। শেখ আবুল ফজলের ধর্ম ছিল মানবধর্ম। মানবতাকে তিনি বিভিন্ন ধর্ম অনুসারে বণ্টন করতে রাজি ছিলেন না। হিন্দু, মুসলমান, পারসি, খ্রিস্টান সকলেই তাঁর কাছে সমান ছিল। সম্রাট আকবরেরও ছিল একই ধর্মমত। যখন লোকে খ্রিস্টানদের বাইবেলের প্রশংসা করল, তখন তিনি শাহজাদা মুরাদকে বাইবেল পড়ার জন্যে বসিয়ে দিলেন এবং শেখ আবুল ফজলকে অনুবাদ করতে লাগিয়ে দিলেন। গুরজাত থেকে অগ্নিপূজক পারসিরা আকবরের দরবারে এসেছিলেন। তাঁরা জরাথুষ্ট্রের ধর্মের কথা কলতে বলতে অগ্নিপূজার মাহাত্ম্য কীর্তন করেন। তারপর আর কি, শেখ আবুল ফজলকে হুকুম দিলেন, ‘ইরানে যেরকম অগ্নিমন্দির চিরকাল প্রজ্বলিত রয়েছে, এখানেও তাই করো। দিনরাত অগ্নি প্রজ্বলিত রাখে।’ অগ্নি পরমেশ্বরের আলোরই এক বিচ্ছুরিত কিরণ। হিন্দুদের মধ্যেও অগ্নিপূজা প্রচলিত হছে। হয়তো সেজন্যেই তিনি তার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। যখন শেখ মুবারকের মৃত্যু হয় তখন শেখ আবুল ফজল তাঁর ভাইদের সঙ্গে মাথামুণ্ডন করেছিলেন। সম্রাট আকবর নিজেও তাঁর মা মরিয়াম মাকানি ওরফে হামিদা বানুর মৃত্যুতে মাথা মুণ্ডন করেছিলেন। লোকজনকে বুঝিয়েছিলেন, এই প্রথা কেবল হিন্দুদের মধ্যেই নয়, তুর্কি সুলতানাতেও রয়েছে। এইসব কারণেই গোঁড়া মুসলমানরা শেখ আবুল ফজলকে বিধর্মী বলত। অথচ, না তিনি বিধর্মী ছিলেন, না ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করতেন। রাত্রিবেলা তিনি সন্ত-ফকিরদের সেবা করতে যেতেন। তাদের চরণে স্বর্ণমুদ্রা প্রণামী দিতেন। তিনি কেবল এইটুকুই কামনা করেছিলেন যে সমস্ত মানুষ নিজেদের ভেদাভেদ ত্যাগ করে নিজের নিজের নিয়মে ঈশ্বরের আরাধনা করুক।বাস্তবে আবুল ফজল, ঐতিহাসিক সমীক্ষার লক্ষ্যে সংখ্যাতাত্ত্বিক উপাত্ত সংগ্রহ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে পথিকৃত্ হিসেবে বিবেচিত হবেন। ১৭৭৬ সালে, ফরাসি বিপ্লবের ১৩ বছর আগে ফরাসি দেশ কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে চলছিল, লা পার টাইফেনটাল প্রকাশিত তাঁর ‘ডেসক্রিপশন জিওগ্রাফি ডি লা হিন্দুস্তান’ পুস্তকে ‘আইন-ই-আকবরি’-তে প্রদত্ত ভূ-সম্পত্তির সামগ্রিক আয় উদ্ধৃতি দিয়েছেন। খুব সম্ভবত আবুল ফজল ছিলেন প্রথম ইন্দো-পারস্য ইতিহাসবিদ যিনি ইউরোপীয়  বিদ্বানদের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছিলেন। যাহোক, তাঁর রচনাবলির একটা নিরপেক্ষ মূল্যায়ন এখনও অভিকাঙ্ক্ষিত রয়েছে। তাঁর রচনাবলি সতর্কভাবে পঠিত হয়েছে, তবে সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করা হয় নাই; তাঁর মতামত হয় অন্ধভাবে গৃহীত হয়েছে নতুবা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, লেখকের সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক মনমর্জি অনুসন্ধানের কোনো ধরনের প্রয়াস ব্যতিরেকেই; মানুষ, আন্দোলন এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ক তাঁর মূল্যায়নকে উচ্চমূল্য দেয়া হয়েছে এবং যথার্থভাবেই: তবে আবুল ফজলের চিন্তাধারার মৌলিক রীতি অনুসন্ধানে কোনো প্রয়াস নেয়া হয় নাই যা চূড়ান্তভাবে তাঁর ইতিহাস বিচারবিবেচনা নির্ধারণ করে। আবুল ফজলকে হয় প্রশংসা করা হয়েছে অথবা নিন্দা করা হয়েছে, তাঁকে অনুধাবন করা হয় নাই।

Post a Comment

Previous Post Next Post