ভারতে ১৭ বার আক্রমণ করেছিলেন গজনীর অধিপতি সুলতান মাহমুদ (৯৩১-১০৩০ খ্রিস্টাব্দ)। বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির ভেঙে লুট করে নিয়ে যান সেখানকার সব সম্পদ। এমনকি ভারতের বিখ্যাত সব রত্নগুলো তিনিই কব্জা করেন বলে ইতিহাসবিদরা জানান। তবে এই অনুচ্ছেদ তাকে নিয়ে নয়। তার সাথে বিখ্যাত এক মনীষীকে নিয়ে একটি গল্প কথিত আছে।
সুলতান মাহমুদ একদিন তার বাগানে অবস্থিত ঘরের ছাদে বসে ছিলেন। সেখানে থাকা সেই মনীষীকে বললেন, সেই বাড়ির চারটি দরজার মধ্যে কোন দরজা দিয়ে সুলতান মাহমুদ বের হবেন, তা যেন সেই পণ্ডিত গুনে ঠিক করেন। তারপর পণ্ডিত যেন তার অভিমত একটি কাগজে লিখে সুলতান মাহমুদের কম্বলের নিচে রেখে যান। সেই পণ্ডিত অঙ্ক কষে বের করেন এই প্রশ্নের উত্তর। তা একটি কাগজে লিখে কম্বলের নিচে রেখে যান। এদিকে, সুলতান মাহমুদ একজন রাজমিস্ত্রীকে ডেকে নিয়ে আসেন। তাকে দিয়ে নতুন করে একটি দরজা বানান তিনি। তারপর বের হয়ে দ্রুত ছুটেন তার কম্বলের নিচের কাগজটি দেখতে। সেখানকার লেখা দেখে তাজ্জব বনে যান সুলতান মাহমুদ। লেখা রয়েছে-
“আপনি পূর্ব দিকের দেয়াল কেটে একটি নতুন দরজা বানিয়ে সেটি দিয়ে বের হবেন”
বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী বীর সুলতান মাহমুদ পণ্ডিতের এই অবাক করা পাণ্ডিত্যকে সাদরে গ্রহণ করতে পারেননি। তার পায়ের আওয়াজে সারা জাহান কাঁপে। তার চেয়ে বেশি মহান হবে কেউ, একথা তিনি কল্পনাই করতে পারেন না। সাথে সাথে তিনি সেই পণ্ডিতকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। রোষানলের শিকার সেই পণ্ডিতের কিছুই করার ছিলো না। তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়া হলো।
কিন্তু সেই পণ্ডিত মারা যাননি, এমনকি বেশি আঘাতও পাননি। কারণ নিচে ছিলো মশামাছি প্রতিরোধের জাল। সেখানে আটকে ধীরে ধীরে নিচে পড়ে যাওয়ায় ভয়ানক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচেন তিনি। সুলতান মাহমুদ আরও রেগে গেলেন। পণ্ডিতকে তার ব্যক্তিগত ডায়েরি নিয়ে আসতে বলা হলো। সেই ডায়েরিতে মূলত ছিলো দৈনিক ভাগ্য গণনা সংক্রান্ত কথা। সেখানকার একটি লেখা দেখেও তাজ্জব বনে যান সুলতান মাহমুদ।
Newsletter
Subscribe to our newsletter and stay updated.
বিখ্যাত এই পণ্ডিতের নাম আল-বিরুনী। পুরো নাম আবু আল-রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল-বিরুনী। ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর পুরাতন অক্সাস নদীর তীরে (বর্তমান আমু দারিয়া নদী নামে অধিক পরিচিত) খোরাসানের একটি জায়গা খোওয়ারিজমে (বর্তমানে এটি উজবেকিস্তানের একটি স্থান) জন্মগ্রহণ করেন আল-বিরুনী। দশম শতকের শেষ এবং একাদশ শতকের শুরুর দিকে বিশ্বের যে সকল মনীষী সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজেদেরকে উজার করে দিয়েছেন তাদের মধ্যে আল-বিরুনী অন্যতম। জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়ন, জীবতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, গণিতবিদ্যা, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, ইতিহাস কিংবা ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিলো তার।
তার ছেলেবেলা নিয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। হয়তো ইতিহাস নিয়ে কাজ করা মহান এই ব্যক্তিত্বের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখতে আগ্রহ বোধ করেননি কেউই। ধারণা করা হয়, তিনি আল ইরাক বংশের রাজপতি আবু মনসুর বিন আলী ইবনে ইরাকের তত্ত্বাবধানে বাল্যকালে শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে আল-বিরুনী তার এক লেখায় জানান, তিনি তার নিজের বাবাকেই ভালো করে চিনতেন না। এমনকি তার বংশ নিয়েও তার কোনো ধারণা ছিলো না।
তার ছেলেবেলা থেকেই যুদ্ধ দেখে এসেছেন তিনি। ২২ বছর ছিলেন রাজার অনুগ্রহে। কিন্তু রাজার অনুগ্রহ বেশিদিন কপালে জোটেনি। তার লালন-পালনকারী সেই রাজার রাজ্যে আক্রমণ করেন সুলতান মাহমুদ। দখল করে নেন সেই রাজ্য। আল-বিরুনী দীর্ঘদিন তার বুদ্ধি দিয়ে এভাবে সুলতান মাহমুদের রাজ্যে হামলা করা ঠেকিয়েছিলেন। কিন্তু তার একার বুদ্ধি হয়তো সুলতান মাহমুদের বীরত্বের নিকট হেরে গিয়েছিলো।
আপনভূমির এমন পরাজয় মেনে না নিতে পেরে রাজ্য থেকে বের হয়ে দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যান আল-বিরুনী। তিনি তখন বুখারায় সামানিদ রাজতন্ত্রের অধীনে কিছুদিন অবস্থান করেন। সেটি ছিলো ইরানের পূর্বাঞ্চল এবং আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে। তিনি তখন রাজা কাবুস ইবনে ভোশ্মগিরের সুনজরে আসেন। রাজা তাকে সম্মানিত করে রাজদরবারে আশ্রয় দেন। সেখানেই ক্যাস্পিয়ান সাগরের নিকট গুরগান শহরে দেখা হয় বিশ্বের আরেক মহান মনীষী দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনার (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) সাথে, যিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। আজও চিকিৎসাশাস্ত্রের কথা এলে তার নাম প্রথম দিকেই থাকবে।
কিন্তু সুলতান মাহমুদ তার প্রভাব বাড়াতে এবার হাত বাড়ান এই রাজতন্ত্রের দিকে। দখল করে নেন পুরো এলাকা। ইবনে সিনা এবং আল-বিরুনীকে তার দরবারে আসন গ্রহণ করতে বলা হয়। পালিয়ে যান ইবনে সিনা। অন্যদিকে নিজের ভূমির মায়া ছেড়ে হয়তো যেতে পারেননি আল-বিরুনী। থেকে যেতে হয় সুলতান মাহমুদের সাথেই। রাজা কাবুসের সাথে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে আল বিরুনীর। তাই নিজের লেখা ‘আল আশার আল বাকিয়াহ’ ও ‘আন আল কুরুন আল খালিয়াহ’ শিরোনামের দুটি বই রাজা কাবুসকে উৎসর্গ করেন তিনি।
গজনিতে অবস্থান করার সময় আল-বিরুনী পরিচিত হন বিখ্যাত পণ্ডিত আবুল খায়েরের সাথে। আবুল খায়েরের নিকট তিনি শিক্ষা নেন গ্রিক ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে। অনেকেই বলে থাকেন, তখনই তিনি ভারতে ভ্রমণ করেছিলেন। একাদশ শতকের শুরুর দিকের কথা এটি। সুলতান মাহমুদের পর তার দুই ছেলের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে জয়ী হন মাসউদ। ক্ষমতা দখল করেন ১০৩১ খ্রিস্টাব্দে।
আল-বিরুনী এই মাসউদের সুনজরেও ছিলেন। এমনকি মাসউদকে তার পক্ষে রাখতে তিনি ফলিত জ্যোতিষ্ক নিয়ে তার লেখা একটি বইয়ের নাম দেন ‘কানুন আল মাসউদ’। তার এই গ্রন্থের ১১টি খণ্ড ছিলো। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে আলোচনা করেছেন বিজ্ঞানের আকর্ষণীয় শাখা জ্যোতির্বিদা সম্পর্কে। তৃতীয় খণ্ডে ত্রিকোণমিতি, ষষ্ঠ খণ্ডে সূর্যের গতি নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। কথিত আছে, এই বইটি তার নামে উৎসর্গ করায় রাজা মাসউদ খুশি হয়ে আল-বিরুনীকে রৌপ্য সামগ্রী উপহার দেন। মহানুভবতার প্রতীক আল-বিরুনী সেগুলো রাজকোষে জমা দিয়ে দেন।
মৃত্যুর ১৩ বছর পূর্বে নিজের কাজের একটি তালিকা করেন তিনি। তালিকা অনুযায়ী তার রচিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ১১৪টি। গণিত, জ্যামিতি ও এই বিশ্বের গঠন সম্পর্কে ৫০৩ অধ্যায়ের বৃহৎ পুস্তক ‘কিতাবুল তাফহিম’ তার রচিত। ‘ইফরাদুল ফা’ল ফিল আমরিল আযলাল’ গ্রন্থে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ছায়াপথ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন তিনি। পৃথিবীর প্রাচীনকালের ইতিহাস নিয়ে তার অনবদ্য রচনা ‘আল আছারুল বাকিয়া আলাল কুবানিল কালিয়া’। যুক্তিবিদ্যায়ও তিনি বই রচনা করেছেন।
তবে যে বইটির জন্য আমাদের উপমহাদেশের মানুষদের কাছে তিনি একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন তা হলো ভারত নিয়ে তার লেখা বই ‘ইন্ডিয়া’।
“বর্বর জাতির ইতিহাসে ক্ষীর সমুদ্র ও দধি সমুদ্র ছাড়া আর কী আছে?”
ভারতবর্ষ ভ্রমণ শেষ করে আল-বিরুনী তখন তার নিজ দেশে ফিরেছেন। তার এক বন্ধুর সাথে ভারতবর্ষ, এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন বন্ধুর মুখ থেকে এমন মন্তব্য শোনার পর তার মনে ভাবোধয় হয়। মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণা তিনি চাইলেই ভাঙতে পারেন। কারণ তিনি ভারতবর্ষে শুধু বেড়াতেই আসেননি। এখানে এসেছেন জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে, এখানকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে। এবার তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতবর্ষ নিয়ে বই লিখবেন। তিনি এমন এক বই লিখলেন যেটি ভারতবাসীর জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে আছে।
কী ছিলো এই বইয়ের বিষয়বস্তু? ভারতের ভাস্কর্য, দর্শন এবং ইতিহাসের রস আস্বাদন করে সেগুলোর বিস্তর প্রশংসা ছিলো তার বইয়ে। ভারতকে জ্ঞানের পূণ্যভূমি হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। ভারতের পণ্ডিতদের জ্ঞানকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন আল-বিরুনী। তবে শুধু প্রশংসা করেই থেমে থাকেননি। এখানকার প্রতিটি কাজকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে।
ভারতের জাদুকররা রসায়নকে বাজেভাবে প্রয়োগ করেছে বলে তিনি খুবই হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে প্রাচীন ভারতের অনুলিপি নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করেছেন। ভারতের সাহিত্যে অতিরঞ্জন তিনি পছন্দ করেননি। এখানকার সংস্কৃত ভাষায় সবকিছুর এত বাড়তি ব্যাখ্যা তার কাছে অহেতুক কাজ বলে মনে হয়েছে। তবে একজন মুসলমান হয়ে তিনি যেভাবে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের, তাদের ইতিহাসের এবং সংস্কৃতির প্রশংসা করেছেন তা ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
উল্টোদিকে, তার স্বদেশীয়দের হিংসাত্মক মনোভাবের গঠনমূলক সমালোচনা করেন আল-বিরুনী। যদিও তারা তার নিজ ধর্মের অনুসারী। অর্থাৎ তার লেখায় স্বাধীনচেতা একটি ভাব ছিলো, যা আজকাল আমরা মুক্তচিন্তা হিসেবেই আখ্যায়িত করি। কিন্তু তিনি তার লেখায় রাশ টেনেছিলেন, পরিবর্তে গঠনমূলক করার চেষ্টা করেছেন তার বইয়ের প্রতিটি বক্তব্য।
আরবি, ফারসি, সিরীয়, গ্রিক, সংস্কৃত, হিব্রু ছাড়াও আরও অনেক ভাষার দখল ছিলো আল-বিরুনীর। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস প্রথম এই ধারণা দেন বলে আমরা জানি। কিন্তু তার জন্মের ৪২৫ বছর পূর্বে এমনই কথা বলে গেছেন আল-বিরুনী।
“বৃত্তিক গতিতে পৃথিবী ঘুরে”
তার আরেকটি অনবদ্য কাজ হচ্ছে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের জটিল সম্পর্ক আমাদের সামনে দাঁড়া করান। তিনিই প্রথম আমদেরকে ধারণা দেন যে, ফুলের পাপড়ি সংখ্যা হয়- ৩, ৪, ৫, ৬ ও ১৮। সেটি কখনোই ৭ বা ৯ হবে না। চিকিৎসাবিদ্যায়ও তার অবদান ছিলো। তিনি বহু রোগের চিকিৎসা জানতেন।
১০৫২ সালে বর্তমান আফগানিস্তানের গজনীতে মহান এই মুসলিম পণ্ডিত আল-বিরুনী না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেন একজন মহাজ্ঞানী। তার কাজগুলো আজ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু তাকে তেমনভাবে স্মরণ করা হয় না। অন্যান্য বিজ্ঞানীরা যেমন মর্যাদা পান, খ্যাতি এখনও বিদ্যমান, আল-বিরুনী তেমনভাবে গুরুত্ব পান না। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি অন্যদের ছাড়িয়ে গেছেন। তার সমকালীনদের চেয়ে, কিংবা কখনও তার পরের প্রজন্মের জ্ঞানীদের চেয়েও।
This bengali article is about muslim scholar Al-Biruni. He was specially famous for his work on mathematics, history, medical science and astronomy.
Feature Image Source: shyamasundaradasa.com
Source:
1. Al-Bīrūnī
2. বিংশ শতকের তিরিশের দশকে 'শিখা' পত্রিকায় আবুল ওদুদের লেখা 'আল বিরুনী।
Tags:
VIP Person