কৌটিল্য, বিষ্ণুগুপ্ত, চাণক্য


কৌটিল্য পরিচিতি

Related image



জন্মঃ খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ অব্দমৃত্যুঃ খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ অব্দ পাটলিপুত্র, মৌর্য্য সাম্রাজ্যবাসস্থানঃ পাটলিপুত্র, মৌর্য্য সাম্রাজ্যনামঃ কৌটিল্য, বিষ্ণুগুপ্ত, চাণক্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ তক্ষশীলাপেশাঃ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উপদেষ্টাউল্লেখযোগ্য কাজঃ অর্থশাস্ত্র, চাণক্যনীতি


কৌটিল্য বা চাণক্য নামটি আমাদের উপমহাদেশের সবার কাছেই কম-বেশি পরিচিত। কূটিলতার ক্ষেত্রে এ নামটি যুগপত্ সম্পৃক্ত। বিশেষত নেতিবাচক কলাকৌশলের ক্ষেত্রে উদ্ধৃতি হিসেবে অহরহ ব্যবহার হয় এ নাম। বিষ্ণুগুপ্ত নামেও কেউ কেউ তাঁকে অভিহিত করে থাকেন। তাঁর জন্ম সম্পর্কিত সর্বজন স্বীকৃত কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, মগধের কাছাকাছি চাণক নামক গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কারোবা মতানুযায়ী তিনি জন্মেছিলেন তক্ষশীলায়। বলা হয়ে থাকে, খ্রিস্টপূর্ব  ৩৭০ সালে এ মহামনীষী জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ৮৭ বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ সালে মৌর্যদের রাজধানী ‘মগধ’-এ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতার নাম চণক ঋষি এবং জন্মস্থানের নাম চণক ছিল বলে কেউ কেউ অনুমান করে থাকেন, যে কারণে অনেকে তাঁকে চাণক্য নামেও অভিহিত করেন। সেকালে মগধ তথা পাটালিপুত্রের সঙ্গে অন্যান্য নগরের মতো তক্ষশীলা নগরেরও প্রগাঢ় সম্পর্ক বা যোগাযোগ ছিল। মুখ্যত তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবাদে রাজধানী মগধের সঙ্গে এ নগরের সম্পৃক্ততা ছিল অত্যন্ত প্রগাঢ়। সেকালের তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল বিশ্বমানের; স্বদেশ ছাড়াও চীন, মধ্য এশিয়া, দূরপ্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশের বিদ্যার্থীরা এখানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য পদার্পণ করতেন। কৌটিল্যও বিদ্যার্জনের নিমিত্ত এখানে সুদীর্ঘ সময় অধ্যয়ন করেন এবং শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর এ বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক তথা আচার্য  হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে যৌবনের প্রারম্ভের পর্যায়ে নন্দ বংশের রাজা মহাপদ্ম নন্দের রাজদরবারে চাকরি গ্রহণ করে অমাত্যের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু রাজদরবারে তাঁর পক্ষে বেশি দিন অবস্থান করা সম্ভব হয়নি। অচিরেই রাজার সঙ্গে তাঁর মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। এ দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের কারণে একদিন ভোজনের সময় তাঁকে রাজা কর্তৃক ধিকৃত হয়ে অপমানজনকভাবে রাজদরবার পরিত্যাগ করতে হয়। রাজদরবার পরিত্যাগের সময় তিনি স্বীয় অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করে রাজাকে সবংশে নিপাতের হুমকি দিয়ে ক্ষুব্ধচিত্তে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন। নন্দ রাজের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে পরবর্তী সময়ে নয় সন্তানসহ রাজা নন্দ’র পুরো বংশের বিনাশ সাধন করে মৌর্য সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চিত্তের, প্রজ্ঞায় অসাধারণ, দুঃসাহসিক মানসিকতা সম্পন্ন এ চাণক্য, বিষ্ণুগুপ্ত বা কৌটিল্য স্বভাবগতভাবে ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, স্থপতি, সমরবিদ, কূটনীতিক, জ্যোতির্বিদ, বৈদিক শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, গণিতজ্ঞ, ধার্মিক, চিকিত্সা শাস্ত্রে সুপণ্ডিত এবং দক্ষ প্রশাসক।


তিনি যে সময়কালের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, সে সময়কালে ভারতে কোনো শক্তিশালী রাজা কিংবা বৃহত্ রাজ্য ছিল না। ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর রাজন্যরা ছিলেন একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে এবং বিবাদে লিপ্ত। কেন্দ্রীয় শক্তির অনুপস্থিতি এবং ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর এহেন দুর্বলতার কারণেই গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের পক্ষে ভারত বিজয় সম্ভব হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। কৌটিল্য বরাবরই বৈদেশিক শাসকদের উপস্থিতির ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনা বহির্দেশীয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে বরাবরই ছিল উজ্জীবিত। যে কারণে নন্দদের উত্খাতের পর তিনি মৌর্যদের মাধ্যমে দখলদার শক্তির পতন ঘটিয়েছিলেন। তাঁরই তত্পরতায় আলেকজান্ডারের গভর্নর সেলুকাসকে মুলতানের যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে এ দেশের পাট চুকিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে মৌর্য সাম্রাজ্য সমগ্র দাক্ষিণাত্যসহ সুদূর ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তিনিই প্রথম ভারতীয় রাজনৈতিক স্থপতি, যিনি রাজতন্ত্রকে একটি কাঠামোগত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক অর্থে তিনিই ছিলেন সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রবর্তক।
তিনি রাজ্য শাসনের প্রশ্নে রাজাকে প্রজা হিতার্থে দায়বদ্ধ করেছিলেন, প্রজাবৃন্দকে রাজার প্রতি অনুগত্য প্রদর্শনের দীক্ষায় দীক্ষিতকরণের রূপরেখা দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে একটি কল্যাণধর্মী সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিলেন। রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর কিছু কিছু কূটবুদ্ধির কারণে পাশ্চাত্যের বিদগ্ধজনেরা তাঁকে প্রাচ্যের মেকিয়াভেলি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। বস্তুত, কৌটিল্যের প্রজ্ঞার পরিধি মেকিয়াভেলির চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল এবং তিনি ছিলেন একটি সুসংহত কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপকার। কার্যত তাঁর মধ্যে বহুমাত্রিক প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল। যদিও বিদেশ নীতি এবং রাজশত্রু নিপাতের ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশিত পথ অনেক নির্মমতা এবং অমানবিকতায় পরিপূর্ণ ছিল, আবহমানকাল থেকে উপমহাদেশীয় রাজাদের চর্চিত নৈতিকতার সঙ্গে তাঁর নির্দেশিত যুদ্ধ-কৌশল ও কূটনৈতিক কৌশল ছিল অত্যন্ত সাংঘর্ষিক, তথাপিও অন্যান্য কল্যাণের দিক বিবেচনা করলে তাঁকে একজন মহান পথপ্রদর্শক হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করাই সঙ্গত। রাজদ্রোহীদের নিধনের ব্যাপারে নানা ধরনের নিষ্ঠুর তরিকা অবলম্বনের কথা বললেও মেকিয়াভেলির মতো তিনি কখনো রাজাকে শৃগালের মতো ধূর্ত হতে কিংবা মিথ্যে কথা বলতে উপদেশ প্রদান করেননি। রাজা-প্রজা নির্বিশেষে সব ক্ষেত্রে তিনি আত্মশুদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। নিষ্কলুষ ধার্মিক জীবনাচারের ব্যাপারে ছিল তাঁর প্রচণ্ড তাগিদ। এ কারণেই তিনি তাঁর নীতি শাস্ত্রে বলেন, One should save his money against hard times, save his wife at the sacrifice of his riches, but invariably one should save his soul even at the sacrifice of his wife and riches.  রাজ্য পরিচালনার নানাবিধ বিষয় নিয়ে তিনি যে গ্রন্থ রচনা করেছেন, তা অর্থশাস্ত্র নামে সমধিক পরিচিত। অর্থশাস্ত্র নাম হলেও এ গ্রন্থে শুধু আর্থিক বিষয়াদির ওপর আলোকপাত করা হয়নি। একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যা যা অত্যাবশ্যকীয়, তখনকার প্রেক্ষাপটে তার পুরোটাই তিনি এ গ্রন্থে সন্নিবেশ করেছিলেন। মানুষের মনস্তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ, বিশে­ষণ, আর্থসামাজিক পরিপ্র্রেক্ষিত বিবেচনা করে এবং ধর্মীয় বিধানগুলো সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনি যে অর্থশাস্ত্র নামক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, আজকে আড়াই হাজার বছর পরও তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নাতীত। বিশেষত অমাত্যদের যোগ্যতা, দক্ষতা এবং জবাবদিহিতার দিকনির্দেশনাগুলো কোনো দিক দিয়েই ম্যাক্স ওয়েবার, জ্যাক রুশো কিংবা অন্যান্য রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। দুর্নীতি সংক্রান্ত তাঁর যে বিশ্লে­ষণধর্মী ব্যাখ্যা এবং সিদ্ধান্ত তা আজো শতভাগ সত্য এবং বাস্তব হিসেবে স্বীকৃত। অধিকন্তু গৃহ নির্মাণ থেকে শুরু করে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের নির্দেশনা, পরিবেশ সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা, কর সংগ্রহ, যুদ্ধনীতি কিংবা আইনের শাসনের ব্যাপারে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা আজো অনুসরণীয় হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। অর্থশাস্ত্র ছাড়াও তিনি নীতিশাস্ত্র নামে আলাদা আরো একটি পুস্তক রচনা করেছেন, সে পুস্তকে সামাজিক জীবনাচারের জন্য অপরিহার্য কিছু হিতোপদেশ প্রদান করা হয়েছে।
-------------
প্রত্যক্ষণ ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, তত্কালীন চিন্তানায়ক ও তদীয় গ্রন্থাদি তথা ভরদ্বাজ, বিশালাক্ষ, পরাশর, পিশুণ, কৌণপদন্ত, বাতব্যাধি এবং মনু সংহিতা, বেদ ও বৈদিক শাস্ত্রের আলোকে তাঁর সামগ্রিক চিন্তাজগত্ আবর্তিত হয়েছে এবং সে আলোকেই দেয়া হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রাসঙ্গিক দিকনির্দেশনা। আর্থসামাজিক ব্যবস্থার নিরিখে তাঁর প্রণীত নীতি-নির্দেশনাগুলো এই আধুনিক সমাজেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অনেকটা সমুজ্জ্বল। সুদীর্ঘ চলার পথে তাঁকে বহুবিধ রাষ্ট্রাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হয়েছে। অ্যারিস্টটল যেমন আলেকজান্ডারের শিক্ষা গুরু ছিলেন, তিনিও তেমনি ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের শিক্ষাগুরু, অধিকন্তু তিনি সরাসরি যুদ্ধ এবং রাজ্য পরিচালনায় সারা জীবনই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিকস’ বা মেকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’ অপেক্ষা তার অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তুর পরিধি অনেক বেশি বিস্তৃত, অগ্রসর এবং কালজয়ী চিন্তা-চেতনার স্ফূরণ বলে আজকের দিনে সর্বমহলে স্বীকৃত। অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি ১৫টি অধিকরণে বিভক্ত। প্রতিটি অধিকরণে স্বতন্ত্র বিষয় আলোচিত হয়েছে। তখনকার দিনে একটি রাজ্য পরিচালনার জন্য যা কিছু অত্যাবশ্যক বলে তাঁর কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল, তার সবই তিনি এ গ্রন্থে আলোচনা করে তদানুযায়ী দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। বস্তুত তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি আজকের দিনে সাংবিধানিক, প্রশাসনিক, বিচারিক, বাণিজ্যিক, বৈদেশিক নীতিসহ সরকার ব্যবস্থার অন্যান্য বিভাগ, উপবিভাগ পরিচালনার ম্যানুয়াল বললে ভুল বলা হবে না।

Post a Comment

Previous Post Next Post